২০/০৯/১৮খ্রি. সকালে খুলনা জেলার রূপসা থানাধীন আলাইপুর গ্রামবাসী পাশ্ববর্তী আঠারোবাকি নদীতে ভাসমান একটি মৃতদেহ দেখতে পায়। খবর দেয়া হল রূপসা থানায়। থানা থেকে পুলিশ এসে নদীতে ভাসমান লাশ উদ্ধার করে। এলাকাবাসীর সহায়তায় জানা যায় ভাসমান লাশটি পার্শ্ববর্তী এলাকার মুছা শিকদার(১৫), দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় এত অল্প বয়সে কৈশোরের দূরন্তপনা ছেড়ে নেমে যেতে হয়েছে জীবিকা খোঁজার রাস্তায়। এলাকায় একটি ছোট মুদির দোকানই মুছা শিকদারের পরিবারের রুটি-রুজির উৎস।
গ্রামে কারো সাথেই কোন ঝামেলা নেই; নিরীহ প্রকৃতির দরিদ্র পরিবারের এই কিশোর এলাকায় সহজ-সরল এবং আত্মভোলা মানুষ হিসেবেই পরিচিত। প্রাথমিকভাবে সবার ধারনা ভিকটিম হয়ত নদীর পানিতে সাতার কাটতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে কেননা ১৫ বছরের এই নিরীহ কিশোরের সাথে কারই বা কি শত্রুতা থাকতে পারে?। ভিকটিম মুছা শিকদারের পরিবারে চলছে শোকের মাতম; অল্প বয়সেই যে ছেলে পরিবারের হাল ধরেছিলো তাকে হারিয়ে দরিদ্র বাবা-মা যেনো শোকে পাথর। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রূপসা থানায় রুজু হয় অপমৃত্যু মামলা। লাশ’কে পাঠানো হয় পোস্টমর্টেমের জন্য। কিছুদিন পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসে পুলিশের। রিপোর্ট দেখে খানিকটা অবাকই হয় পুলিশ কর্মকর্তারা। ভিকটিম মুছা শিকদার পানিতে ডুবে মারা যায়নি, তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে জানতে পেরে ভিকটিমের মাতা বিজ্ঞ আদালতে পিটিশন দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশক্রমে একাধিক সন্ধিগদ্ধ ব্যক্তিকে আসামী করে রূপসা থানায় দন্ডবিধি-৩৬৪/৩০২ ও ৩৪ ধারা মোতাবেক একটি মামলা রুজু হয়। বিষয়টি নজরে আসে পুলিশ সুপার(এসপি), খুলনা মহোদয়ের; মানবিকতার তাগিদে তিনি ভিকটিমের পরিবারের পাশে দাড়ান। পুলিশ সুপার মহোদয় মামলাটির তদন্তভার চৌকস খুলনা জেলা গোয়েন্দা শাখা(ডিবি)’র উপর হস্তান্তর করেন। দরিদ্র এই বাবা-মা’কে যারা সন্তানশূণ্য করেছে তাদের’কে যে কোন উপায়ে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতেই হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। পুলিশ সুপার মহোদয়ের দৃঢ় মনোবল, ঘটনার রহস্য উদঘাটনে যে কোন ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। মামলার রহস্য উন্মোচনে বদ্ধপরিকর খুলনা জেলা ডিবির সদস্য’রা মাঠে নেমে পড়ে; লক্ষ্য একটাই অপরাধীকে সনাক্ত করা। ইতোমধ্যে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ০৫(পাঁচ) জন’কে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। রাতের আধাঁরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ভিকটিমের গ্রামে, বিভিন্ন কৌশলে এলাকার লোকদের কাছ থেকে ভিকটিমের তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে থাকেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা একাধিকবার হত্যাকান্ড ঘটানোর স্থানে গিয়েও বসে বসে অনুমান করার চেষ্টা করলেন কিভাবে ভিকটিম’কে হত্যা করা হয়? হাজার হাজার প্রশ্ন উকি দিতে লাগলো ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তার সন্দীহান মনে। ভিকটিম’কে কি অন্য কোথাও হত্যা করে পরে নদীর পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে? নাকি নদীর তীরেই হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে? কতজন মিলে হত্যা করা হয়েছে? নিরীহ এই কিশোর হত্যার পিছনে কারন কি হতে পারে?। ভিকটিমের পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খুঁজছেন সন্তোষজনক তথ্য এবং উপাত্ত। অন্যদিকে মানবতার সেবাই এগিয়ে এলেন পুলিশ সুপার মহোদয়, তিনি ভিকটিমের পরিবার’কে একাধিকবার অফিসে ডেকে এনে সান্তনা দেন এবং মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে ভিকটিমের পরিবার’কে আশ্বস্ত করেন পাশাপাশি ভিকটিমের অসহায় দরিদ্র পরিবার’কে নিয়মিতভাবে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখেন। এমতাবস্থায় পুলিশ সুপার, খুলনা মহোদয়ের নির্দেশনায় নেয়া হল উন্নত তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের উপর চালালেন উন্নত তথ্য প্রযুক্তির নজরদারি। উন্নত তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকল নিরপরাধ কিশোর মুছা শিকদার হত্যাকান্ডের রহস্য। উন্নত তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জানা গেল হত্যাকান্ড ঘটানোর স্থানে সেদিন রাতে আসলে কারা উপস্থিত ছিলো। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোটামুটি নিশ্চিত হলেন হত্যাকারীর পরিচয় সম্পর্কে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দফায় দফায় পুলিশ সুপার, খুলনা মহোদয়ের সাথে মামলার বিষয়ে কথা বললেন, জানালেন অগ্রগতি সম্পর্কে। পুলিশ সুপার মহোদয়ের লক্ষ্য একটাই; যে কোন উপায়ে নিরপরাধ এই কিশোর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে হবে এবং দরিদ্র বাবা-মা যেন ন্যায় বিচার লাভ করে তা নিশ্চিত করা এবং একই সাথে নির্দেশ দিলেন হত্যাকারী’কে আটকপূর্বক ঘটনার সাথে জড়িত অন্যান্য’দের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য। পুলিশ সুপার মহোদয়ের নির্দেশে রূপসা থানাধীন আলাইপুর গ্রাম থেকে হত্যাকারী’কে আটক করে জেলা গোয়েন্দা(ডিবি) শাখার সদস্য’রা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাতভর চালালেন গভীর জিজ্ঞাসাবাদ। ধুরন্ধর হত্যাকারী ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা বিভিন্ন কৌশলে এড়িয়ে যেতে লাগলেন; অন্যদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তার হাতে রয়েছে উন্নত তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাওয়া নিশ্চিত প্রমান। জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ভট এবং অবাস্তব তথ্য দিতে লাগল হত্যাকারী অন্যদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার হাতে থাকা প্রমান একেরপর এক উপস্থাপন করতে থাকলেন হত্যাকারীর সামনে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সকল সত্য স্বীকার করলেন এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অপর ০৩(তিন) আসামীর পরিচয় প্রকাশ করলেন। আসামীদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়; অপর এক আসামী এবং ভিকটিমের সাথে দোকানের বকেয়া লেনদেন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় এছাড়াও ভিকটিমের পরিবারের সাথে বর্ণিত আসামীর পরিবারের পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আসামীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ভিকটিম কিশোর মুছা শিকদার’কে তাঁর মুদি দোকান থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় কৌশলে ডেকে মটরসাইকেলযোগে এলাকার পার্শ্বে বহমান আঠারোবাকি নদীর পশ্চিম তীরে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীর পানিতে ফেলে দিয়ে গা ঢাকা দেয়। পুলিশ সুপার মহোদয়ের দূরদর্শীতা এবং অফিসার ইনচার্জ, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি), শাখার নিরলস পরিশ্রম এবং নাছোড়বান্দা মনোভবের কারনে অবশেষে উন্মোচন হল কিশোর মুছা শিকদার হত্যাকান্ড রহস্যের। অসহায় দরিদ্র বাবা-মা পেলে তাদের সন্তান হত্যার ন্যায় বিচার।